fbpx

অ্যাডভোকেটশীপ পরীক্ষায় ফেল করার প্রধান পাঁচ কারণ

বলা হয়ে থাকে ‘ব্যর্থতাই সফলতার একমাত্র স্তম্ভ বা খুঁটি ‘। তবে বাস্তবে দেখা যায়, যারা ব্যর্থ হন তারা ব্যর্থতার পর ব্যর্থতা অর্জন করতেই থাকেন। এর কারণ হল, যারা বারবার ব্যর্থ হন তারা অতীতের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন না। অন্যদিকে, যারা জীবনে সফল হন তারাও বারবার ব্যর্থ হন এবং সেই ব্যর্থতাকে বিশ্লেষণ করে ব্যর্থতার কারণ খুঁজে বের করেন এবং সেই অনুযায়ী নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেন। ফলে তারা অতীতে যে ভুলগুলো করেছেন সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করেন না এবং সফলতা অর্জন করেন।

আপনি যদি প্রথম বারের মত বার কাউন্সিল পরীক্ষার্থী হন, তাহলে খুব সম্ভাবনা আছে আপনি ফেল করবেন। আর আপনি যদি ইতোমধ্যে একবার ফেল করে থাকেন, তাহলে পূর্বের অভিজ্ঞতা বলে আপনার বারবার ফেল করার সম্ভাবনা প্রবল। তবে পরীক্ষা যত কঠিনই হোক না কেন আপনি যদি গণহারে ফেল করার কারণগুলো একবার বুঝে যান, তাহলে আপনি নিশ্চিতভাবেই পাশ করে আসবেন।

আমি ব্যক্তিগতভাবে অকৃতকার্য ৫০ জন পরীক্ষার্থীর উপর গবেষণা করে অ্যাডভোকেটশীপ পরীক্ষায় ফেল করার বেশ কয়েকটি কারণ খুঁজে পেয়েছি। এদের বেশিরভাগ পরীক্ষার্থীর সাথে আমি আলোচনা করেছি তারা কিভাবে পড়েছেন, কতক্ষণ পড়েছেন, যারা এমসিকিউতে ফেল করেছেন তারা কি কি ভুল করেছেন, যারা রিটেনে ফেল করেছেন তারা কোন প্রশ্নের উত্তর কিভাবে দিয়েছেন, এবং বেশ কয়েকজনের সাথে আমি আইনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারা নিয়ে আলোচনায় বসেছি। এভাবে পর্যালোচনার মাধ্যমে পরীক্ষার খুঁটিনাটি বিষয়ে আমি বেশ কিছু ধারণা পেয়েছি যেগুলো আমি পাঁচটি পর্বে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করব। প্রথম পর্বে আমি আলোচনা করব, বার কাউন্সিল পরীক্ষার্থীরা কেন গণহারে ফেল করে এ বিষয়ে।

খুঁটিনাটি বিষয়ে নজর না দেয়া

শুরুতেই একটা গল্প বলি। মেডিকেল শিক্ষার্থীদের এনাটমির প্রথম ক্লাস। প্রফেসর সাহেব এলেন। ট্রের উপরে লাশ। তিনি লাশের কাছে গেলেন, শিক্ষার্থীদের বললেন মনোযোগ দিয়ে দেখ, আমি কি করছি। এরপর তিনি লাশের মুখ খুলে ভিতরে আঙুল দিলেন, একটু নাড়াছাড়া করে আঙ্গুল থেকে গন্ধ শুঁকে দেখলেন। তারপর নিজের জিভে আঙুল দিয়ে আঙুলের স্বাদ নিলেন। তারপর বললেন, এবার তোমাদের পালা, আমি যা যা করেছি তোমরা ঠিক তা তাই কর। প্রফেসর সাহেব যা যা করলেন সবাই তাই করলো। এবার প্রফেসর সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন, দেখ আমি লাশের মুখে দিয়েছি তর্জনী আর আমার মুখে দিয়েছি মধ্যমা। আর তোমরা সবাই লাশের মুখে তর্জনী দিয়ে নিজের মুখেও তর্জনীই দিয়েছো। মনে রাখবে, ডাক্তারী পড়ায় সফলতার মূলমন্ত্র হচ্ছে গভীর মনোযোগ এবং সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ। এই গল্পটা মেডিকেল  ক্লাসকে কেন্দ্র করে হলেও এটা মেডিকেল শিক্ষার্থীদের জন্য নয়। এই গল্পটা মূলত আইনের ছাত্রদের জন্য তৈরি একটি গল্প।

সুতরাং অ্যাডভোকেটশীপ পরীক্ষায় ফেল করার প্রথম কারণ হচ্ছে, খুঁটিনাটি বিষয়ে নজর না দেয়া। মনে রাখবেন ‘মধ্যমার’ জায়গায় ‘তর্জনী’ মুখে দিলেই সর্বনাশ। লক্ষ্য করুন আমি বলছি, ফেল করার প্রথম কারণ ‍খুঁটিনাটি বিষয়ে নজর না দেয়া, সম্পূর্ণ আইন না পড়া একথা বলিনি। পরীক্ষায় পাশ করার জন্য সম্পূর্ণ আইন পড়তে হবে না, যেসব ধারা থেকে সাধারণত প্রশ্ন আসে শুধুমাত্র সেসব ধারাগুলোই পড়তে হবে। তবে যে ধারাগুলো পড়তে হবে সেগুলোর খুঁটিনাটি বিষয়গুলোতে অবশ্যই নজর দিয়ে পড়তে হবে এবং ভালোভাবে বুঝতে হবে। বিশেষ করে প্রত্যেকটি ধারার প্রত্যেকটি শব্দকে আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করে পড়তে হবে। মনে রাখবেন, ব্যবহারভেদে একই শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ হতে পারে।

অন্যের মাথা দিয়ে বুঝা

বার কাউন্সিল পরীক্ষায় গণহারে ফেল করার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, প্রত্যেকটি আইনকে অন্যের মাথা দিয়ে বুঝা। বিষয়টি একটু পরিষ্কার করে বলি। বেশিরভাগ পরীক্ষার্থীই ধারাগুলো নিজে বুঝার চেষ্টা না করে অন্যের বুঝানোর উপর নির্ভর করেন। এরা পরনির্ভরশীল। অন্যের বুঝানোটা বুঝার মধ্যে দোষের কিছু নেই, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যিনি বুঝাচ্ছেন তিনি নিজেই বিষয়টি বুঝেন কিনা এটা একটা বড় প্রশ্ন। এখন যিনি  বুঝাচ্ছেন তিনি যদি নিজেই ভুলটা জানেন বা ভুল ব্যাখ্যা করেন, তাহলে যিনি বুঝে নিচ্ছেন তিনিও নিশ্চিতভাবেই ভুল করবেন। এ ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে যারা বিভিন্ন কোচিংয়ে পড়ান বা অনলাইনে পড়ান তাদের ৯৫  ভাগ ক্ষেত্রে বেশিরভাগই ভুল পড়ান, আর শতভাগ ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই কিছু না কিছু জিনিস ভুল পড়ান। মনে রাখতে হবে, যতবড় আইনজীবী বা যতবড় প্রফেসরই হোন না কেন বা যদি কেউ বড় মাপের কোন বিচারকও হন তথাপিও ভুলের উর্ধ্বে কোনো মানুষই নয়। সুতরাং, যখন কেউ কোনো একটি ধারা বুঝাবে, বা কোনো গাইড বইয়ে যখন কোনো ধারা পড়বেন তার সঙ্গে মূল আইনটা মিলিয়ে দেখা আপনার দায়িত্ব। মনে রাখবেন, আপনার পড়া আপনাকেই পড়তে হবে এবং আপনার বুঝা আপনাকেই বুঝতে হবে। অন্যে কি বুঝেছে বা কি বুঝিয়েছে তার উপর নির্ভর করলে ফেল করার প্রচুর সম্ভাবনা থাকে। প্রত্যেকটি ধারা অন্যের মাথা দিয়ে না বুঝে নিজের মাথা দিয়ে বুঝার চেষ্টা করুন, দেখবেন আপনার পক্ষে বরং ফেল করাটাই কঠিন হয়ে যাবে।

শর্টকার্ট অবলম্বন করা

বার কাউন্সিল পরীক্ষায় গণহারে ফেল করার তৃতীয় কারণ হচ্ছে, শর্টকার্ট অবলম্বন করা। কিছু পরীক্ষার্থী আছেন যারা সব সময়ই  শর্টকার্ট খোঁজেন। মনে রাখবেন সবসময় সব জায়গায় সব শর্টকার্ট ফলপ্রসূ হয় না। বর্তমান সময়ে পৃথিবীর সর্বোচ্চ উঁচু ভবন বুর্জ খলিফার ২,৭১৭ ফিট উচ্চতায় ওঠার জন্য লিফট ব্যবহার করা যতটা বুদ্ধিমানের কাজ, একই উচ্চতার কোন পাহাড়ে ওঠার জন্য লিফট ব্যবহার করতে চাওয়াটা ঠিক ততটাই বোকামি কাজ। পাহাড়ে উঠার শর্টকার্ট হচ্ছে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠা অথবা এর সর্বনিম্ন শর্টকাট হচ্ছে পাহাড়ে উঠার উপযোগী গাড়ি ব্যবহার করা।

মোদ্দা কথা হল, বর্তমান পরিস্থিতিতে যেকোনো শর্টকার্ট অবলম্বন করে হয়তো হায়ার মার্কস নিয়ে এলএলবি অনার্স এমনকি এলএলএম-ও পাশ করা যেতে পারে, কিন্তু বার কাউন্সিল পাশ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অতএব, ২০২৪, ২০২৫ বা পরবর্তী যেকোনো বার কাউন্সিল পরীক্ষায় পাশ করতে চাইলে শর্টকাটে প্রস্তুতি নিয়ে বা নেতা ধরে অথবা নকল করে বা টাকা দিয়ে পাশ করা ইত্যাদি অমূলক ধ্যানধারণা বাদ দিয়ে যতটুকু শ্রম দরকার তার পুরোটাই দেয়ার মানসিকতা নিয়ে পড়তে হবে।

সম্পূর্ণ আইন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়ে সময় নষ্ট করা

অনেকেই খুঁটিনাটি বিষয়ে নজর দেয়া বলতে সম্পূর্ণ আইনটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়াকে বুঝেন। এটা ভ্রান্ত ধারণা। যারা শর্টকাটে পড়া এবং অপ্রয়োজনে অতিরিক্ত পড়ে সময় নষ্ট করার মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন না তারা ঝুঁকি এড়াতে সবকটি আইন সম্পূর্ণরূপে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়তে গিয়ে সময় নষ্ট করে ফেলেন। ফলে তারা ফেল করেন।

সুতরাং , ফেল করার চতুর্থ কারণ হচ্ছে, অপ্রয়োজনী ধারাগুলোসহ সম্পূর্ণ আইন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়ার চেষ্টা করা। যদি আপনি বিগত বছরের  প্রশ্নপত্রগুলো বিশ্লেষণ করেন দেখবেন অল্প কিছু ধারা আছে যেগুলো থেকে প্রত্যেক বছর প্রশ্ন আসে। সুতরাং, আপনার উচিত হবে বিগত পাঁচ বছরের, তা না হলে অন্তত তিন বছরের প্রশ্নপত্র বিশ্লেষণ করে যে ধারাগুলো থেকে বার বার প্রশ্ন আসে শুধুমাত্র সেগুলোর প্রতি নজর দেয়া। আমি শুরুতেই বলেছি, ‍খুঁটিনাটি বিষয়ে নজর না দেয়া এবং সম্পূর্ণ আইন পড়ে নেয়া এক কথা নয়। এখন থেকে অপ্রয়োজনীয় ধারাগুলোতে নজর দেয়া বন্ধ করুন এবং একই সাথে প্রয়োজীয় ধারাগুলোকে পুংখানুপুংখভাবে নখদর্পণে নিয়ে আসুন তাহলেই আপনার পাশ নিশ্চিত হবে।

একই ভুল বারবার করা

এবার আসছি অ্যাডভোকেটশীপ পরীক্ষায় ফেল করার পঞ্চম কারণে। এটা এমন একটা কারণ যে কারণটি একই  পরীক্ষার্থীর বারবার ফেল করার জন্য দায়ী। যারা বার বার ফেল করে তাদের বারবার ফেল করার একমাত্র কারণ হলো, একই ভুল বারবার করা। একই ভুল বারবার করা একথাটির দুইটি অর্থ হতে পারে-

প্রথমত, কেউ সর্বপ্রথম যেটা শিখেছে সেটাকেই চূড়ান্ত মনে করে সেই জিনিস বারবার মুখস্ত করতে থাকা। অনেক পরীক্ষার্থী আছেন যারা হয়তো ঘটনাক্রমে কোন প্রভাষকের কাছ থেকে বা কোন কোচিং সেন্টার থেকে বা কোন একটা বই থেকে কিছু একটা ভুল জিনিস শিখলো এবং যেখান থেকেই শিখুক না কেন তারা সে ভুল জিনিসটাকে চূড়ান্ত মনে করে ওই ভুলের উপরেই পড়ে থাকে এবং সেটাকে বারবার মুখস্ত করে। আমি আগেই বলেছি, যতবড় মাপের আইনজীবী বা যতবড় মাপের প্রভাষকই হোন না কেন এমনকি তিনি যদি বড় মাপের কোন বিচারকও হন ভুলের উর্ধ্বে কোনো মানুষই নয়। সুতরাং একই ভুল জিনিস আপনি যত ভালোভাবেই মুখস্ত করেন না কেন আপনার পক্ষে ফেল করাটাই স্বাভাবিক।

একই ভুল বারবার করার দ্বিতীয়  অর্থটি  হচ্ছে, আমি ফেল করার যে পাঁচটি  উপায় আলোচনা করেছি, তারা এই পাঁচটি  উপায়ের এক বা একাধিক উপায় ঘুরেফিরে প্রত্যেকবার অবলম্বন করে। একদল আছে যারা, আগের বার যে পদ্ধতিতে পড়েছে পরের বারও একই পদ্ধতিতে পড়ে, আগের বার যে কোচিংয়ে পড়েছে পরেরবারও সেই একই কোচিংয়ে পড়ে বা এরা বারবার কোচিং পরিবর্তন করে কিন্তু কোন কোচিং সঠিকভাবে পড়ায় কোন কোচিং সঠিক ব্যাখ্যা দেয় সেটা যাচাই করার প্রয়োজন বোধ করেনা, এরা সর্বপ্রথম যে ব্যাখ্যাটি জেনেছে, বা সে যার ভক্ত ঐরকম কোন টিচার বা আইনজীবী যে ব্যাখ্যাটি দিয়েছে সেটাকে চূড়ান্ত মনে করে সে ব্যাখ্যার উপর পড়ে থাকেন, আগের বার যে নোটগুলো পড়েছেন পরের বারও সেই নোটগুলোই ফলো করেন। অর্থাৎ,

১. এরা খুঁটিনাটি বিষয়ে নতুন করে মনোযোগ দেয় না,

২. তারা যার কাছ থেকে যা শিখেছে তা কি সঠিকটা শিখেছে নাকি ভুলটা শিখেছে তা যাচাই করার প্রয়োজন বোধ করে না,

৩. এরা আগেরবার যেসব শর্টকার্ট অবলম্বন করেছে পরের বারও একই শর্টকার্টে হাঁটে,

৪. যারা আগের বার অপ্রয়োজনীয় ধারা পড়ে সময় নষ্ট করেছে তারা আবারও আরও বেশি করে নতুন নতুন ধারা পড়ে আরও বেশি সময় নষ্ট করে,

৫. এরা ভুল সংশোধন না করে ভুলটাই বারবার মুখস্ত করতে থাকে।

সুতরাং, যারা একবার ফেল করেছেন তারা, আগের বার যা যা করেছেন, যা যা পড়েছেন তার সবটুকু ভুলে যান এবং নতুন করে নতুন উদ্যমে নতুন পদ্ধতিতে পড়া শুরু করুন। আর আমি এই ওয়েবসাইটে যে আলোচনাগুলো করব সেগুলো অন্তত একবারের জন্য হলেও পড়ে  নিবেন, আপনি অবশ্যই নতুন জীবনের সন্ধান পাবেন।

মিফতাহুর রহমান, অ্যাডভোকেট, ঢাকা জজ কোর্ট

2 thoughts on “অ্যাডভোকেটশীপ পরীক্ষায় ফেল করার প্রধান পাঁচ কারণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from আইনের উন্মুক্ত পাঠশালা

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading